স্বাধীনতা যুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন একজন পাকিস্তানি সাংবাদিক। ১৯৭১ সালে তিনি করাচির দ্য মর্নিং নিউজ'র সহ-সম্পাদক ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য সানডে টাইমস'র পাকিস্তান প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধচলাকালীন ১৪ এপ্রিল যে আট জন সাংবাদিককে সরকারিভাবে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এমন প্রতিবেদন তৈরি করা। অথচ তিনি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করলেন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ-যা তাঁকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, চিন্তিত ও বিষণ্ণ করে তুলেছিল। কিছুদিন বিচলিত থেকে অবশেষে সত্য প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরিবার ও নিজের জীবন বিপন্ন করে, দেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের চোখে ধুলো দিয়ে লন্ডনে পৌঁছান। এরপর ১৩ জুন ১৯৭১ দ্য সানডে টাইমসে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর দুনিয়া কাঁপানো প্রতিবেদন- গণহত্যা (GENOCIDE)। যে প্রতিবেদন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও নৃশংসতার প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ।
Neville Anthony Mascarenhas (10 July 1928 – 3 December 1986) was a Pakistani journalist and author. His works include exposés on the brutality of Pakistan's military during the 1971 independence movement of Bangladesh, The Rape of Bangladesh (1972) and Bangladesh: A Legacy of Blood (1986).
Mascarenhas was born into a Goan Catholic family in Belgaum, and educated in Karachi.He and his wife Yvonne Mascarenhas together had five children. He died in 1986.
Mascarenhas was a journalist who was the assistant editor at The Morning News (Karachi).[3] After collecting information on the atrocities committed in Bangladesh, he realised he could not publish the story in Pakistan and contacted Harold Evans of The Sunday Times. Before the publication of his report in 1971, he moved his family to Britain.[4] Thereafter, he worked for 14 years with The Sunday Times. Afterwards, he was a freelance writer.
In 1972, he won Granada's Gerald Barry Award ('What The Papers Say') and the International Publishing Company's Special Award for reporting on the human rights violations committed during the Bangladesh Liberation War.[5] His article "Genocide" in The Sunday Times on 13 June 1971 is credited with having "exposed for the first time the scale of the Pakistan army's brutal campaign to suppress its breakaway eastern province".
The BBC writes: "There is little doubt that Mascarenhas' reportage played its part in ending the war. It helped turn world opinion against Pakistan and encouraged India to play a decisive role." Indian Prime Minister Indira Gandhi stating that Mascarenhas' article led her "to prepare the ground for India's armed intervention".
The Bangladeshi government honoured Mascarenhas's contribution to the nation during the 1971 liberation war by preparing an official list of names.
❛Either I would write the full story of what I had seen, or I would have to stop writing, I would never again be able to write with any integrity.❜
দুঃখভারাক্রান্ত মনে কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু দ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক ❛দ্য সানডে টাইমসে❜র তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিনিধি। তিনি সেই সব সাহসী মানুষদের একজন যিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চোখ রাঙানো পরোয়া না করে বিশ্ববাসীর কাছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের করা হ ত্যাযজ্ঞ এবং অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা সবার কাছে তুলে ধরেন।
নিজেদের করা অন্যায়কে ঢাকতে পশ্চিম পাকিস্তান এবং বিশ্ববাসীর কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক প্রমাণ করার জন্য, সে সময় আটজন সাংবাদিককে সরকারিভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। সহজ কথায় তাদের কাজ ছিল পাকিস্তান সরকারের পা-চাটা একটা ফরমায়েশি রিপোর্ট প্রদান করা। একই কাজ অ্যান্থনিও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অপরাধবোধে নিজের কাঁধ এত ভারী হয়ে যায় যে, নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে তার। তাই ঝুঁকি নিয়ে তিনি পরে ১৩ই জুন ❛G E N O C I D E❜ নামের রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। সে সময়ে বাঙালিদের ওপর করা নিষ্ঠুর নির্যাতনের এই প্রামাণ্য দলিল পুরো বিশ্বকে চমকে দেয়।
অ্যান্থনি তার ১০ দিনের ভ্রমণে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন সবকিছু। পাকিস্তানি সেনারা যেসব অজুহাত দেখিয়ে তাদের করা নৃশংস আচরণকে জাস্টিফাই করছিল সেসব কথাও তিনি সামনে থেকে শুনেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পাক সেনা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। কীভাবে নারিকেলের দুধ পান করতে করতে মৃ ত্যু পরোয়ানার তালিকায় স্বাক্ষর করেছিল মেজর, কীভাবে একজনকে মা রতে তিনবার গু লির ব্যবহার হয়েছিল সেসব কথা তিনি তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন। আব্দুল বারি নামের এক দর্জি কীভাবে কারফিউয়ের সময় হানাদার বাহিনির সামনে দিয়ে দৌঁড় দেওয়ায় পাকড়াও হয়েছিল। অনেক অনুনয় বিনয় করে সে মুক্তি পেয়েছিল তার চাক্ষুষ প্রমাণ ছিলেন অ্যান্থনি।
বইটা পড়ার সময় মনে হবে ৭১ এর সময় পাকিস্তানিদের উপর যেন কোনো শ য়তান ভর করেছিল যারা র ক্তের নেশায় উন্মত্ত। বাঙালি, মুসলিম, হিন্দু, ছাত্র, আওয়ামী কর্মী নির্বিশেষে তাদের মূল মিশন ছিল দেখামাত্র গু লি করা। ভয়ানক এবং হৃদয়বিদারক সেসকল পাপ কর্মের নানা ভারিক্কি নামও দিয়েছিল তারা।
২৫শে মার্চের সেই কালরাতে নির্মমভাবে খু ন হওয়া লাশগুলো ১৫ এপ্রিলেও ঝুলে ছিল ছাদে, পঁচে দুর্গন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কী নির্মম! কী ভয়ানক মৃ ত্যু লেখা ছিল নিরপরাধ এই মানুষগুলোর জীবনে!
মিলিটারিদের সাথে গাড়িতে ভ্রমণের সময় এখানে সেখানে লা শ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। পাক সেনারা তাদের কর্ম নিয়ে গর্ব করত, কেউ আবার মাত্র ৬০ জনকে হ ত্যা করতে পারায় আফসোস করত।
অনেক জনবহুল শহর ভূতের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অ্যান্থনি প্রশ্ন করেছিল, ❛শহরের লোক সব কোথায়?❜ উত্তরে পিশাচ বাহিনী বলেছিল, ❛তারা গ্রামে গেছে।❜ তবে এর আসল অর্থ ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন এই সাংবাদিক। নারিকেল পাতা দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দোকান পুড়িয়ে বিজয়ের হাসি হাসছিল তারা।
নামকাওয়াস্তে সভা করে তাদের প্রতি লোকের সন্তুষ্টি আছে সেই প্রমাণের জন্য পাক সরকার জলের মতো টাকা খরচ করছিল। পশ্চিম থেকে হাজার হাজার সেনা এনেছিল শুধু বিদ্রোহ প্রতিরোধ করতে। জয় কিংবা শাসন করা ছাড়া দুই পক্ষের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। জয়ী হতে তারা মরিয়া।
যু দ্ধের ফলে গ্রামের পর গ্রাম, সেতুসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল খাদ্যে। দুর্ভিক্ষ হবার সম্ভাবনাও দেখা যায়। কিন্তু নিষ্ঠুর সেই হানাদার বাহিনীর কাছে না খেতে পেয়ে ম রার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাঙালি এবং হিন্দু দমন। সুজলা সুফলা সুন্দর দেশের প্রতি কোণায় তখন শুধু লা শের গন্ধ।
অ্যান্থনি তার ১০ দিনের সংগ্রহ করা রিপোর্টে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা, পড়লে আপনিও শিউরে উঠবেন! শিউরে উঠেছিল ৭১-এর বিশ্ববাসীও। অন্যায়, পাপ যত চেষ্টাই করা হোক না কেন চাপা থাকে না। তার ফল ভোগ করতেই হয়। নিরস্ত্র, অপ্রশিক্ষিত বাঙালির মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনাই এর প্রমাণ।
বইটা পড়ে কেমন লেগেছে আশা করি সে সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বিষয়ের যেকোনো কিছু পড়তেই অন্যরকম আবেগ কাজ করে, সেই সাথে কাজ করে গর্ব। কঠিন এই সময়ে যারা নিজের স্বার্থ থেকেও দেশমাতৃকার কথা চিন্তা করে বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা অ্যান্থনির মতো সাংবাদিকদেরও। যারা ক্ষমতা কিংবা চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে সত্য প্রচারে কখনো পিছপা হননি।
৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে ঘটে যাওয়া যে ঘটনা আমাদের নিজস্ব দেশ, ভাষা— উপহার দিয়েছে তার সঠিক ইতিহাস বর্তমানের মানুষ কতটুকুই বা জানি? নতুন যুগের বাংলাদেশিদের উচিত বইটা পড়া এবং অন্যকেও পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা পায়ের নিচে যে মাটিতে হেঁটে বেড়াই তাতে লাখো শহীদের র ক্ত শুকিয়ে গেছে। চাপা পড়ে আছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লা শ। কষ্ট হয় যখন বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবসের আম জনতার সাক্ষাৎকারে শুনি। তারা বলে, বাংলাদেশের বিজয় দিবস ২৬শে মার্চ, স্বাধীনতা দিবস ১৬ই ডিসেম্বর আর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি দেশ স্বাধীন করতে যু দ্ধ করেছিল। নিজের চেতনাবোধের সামান্য এক বিন্দু টিকিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযু দ্ধের ইতিহাস জানাটা খুব জরুরি।
অনুবাদ :
সুবীর বৈরাগীর করা অনুবাদটা মোটামুটি মানের লেগেছে। কিছু জায়গায় পড়তে কঠিন কঠিন লাগছিল। তবে ৭৮ পেইজের ছোট্ট বই এবং তার মূল ঘটনার জন্য অনুবাদের কাঠিন্য ধাতে না নেওয়াই যায়।
বইটির গুডরিডস রেটিং (২.৬৭) দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। অনুবাদের জন্য এমন রেটিং নাকি অন্য কারণ জানা নেই।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ৪৭ এর দেশভাগের পর পাকিস্তানে থেকে যান এবং 'দ্য মর্নিং নিউজ' ও 'দ্য সানডে টাইমস' এ সাংবাদিকতা করেন। ৭১ এর গনগহত্যার আগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে ৮ জন সাংবাদিককে উড়িয়ে আনা হয় 'দেশের অবস্থা স্বাভাবিক' সেটা উপস্থাপনের জন্য তার মধ্যে তিনি একজন। বাকি ৭ জন পাকিস্তান সংসারের চাটুকারিতা করলেও একমাত্র অ্যান্থনি বিবেকের দংশনে তা করেননি। দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের 'গনহত্যা'র বিষয়টি প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেন। তার দেখানো এইসাহসটুকুর বাঙালি আজও তাকে শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে।
১৯৭১ সাল থেকে আজ অবধি চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের ভূরাজনীতির ছলে কিছু মানুষ এখনো 'গণহত্যা' নিয়ে প্রশ্ন তোলে! ২০২৪ সালে এসেও আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতি নিয়ে পশ্চিমাদের পেছনে ছুটতে হয়, এটাই সবথেকে আফসোস এর বিষয়।
🟥পাকিস্তানি ধূম্রজালঃ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে বাঙাল��দের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় ৮ জন সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তানে উড়িয়ে আনে। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ও বহির্বিশ্বের কাছে এমন একটা ধারণা তৈরী করা যে ২৫শে মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল সেটা ধামাচাপা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে তুলে ধরা। এই সাংবাদিকদলের একজন ছিলেন করাচির দ্য মর্নিং নিউজের সহসম্পাদক ও দ্য সানডে টাইমসের পাকিস্থান প্রতিনিধি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১৯৭১ সালের ২ মে দ্য সানডে টাইমসে পাকিস্তান সরকারের ফরমাশ মতো মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যাতে নির্বিচারে গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া এমনকি দুর্ভিক্ষের বিষয়গুলো চেপে যাওয়া হয়। 🟥চোরের মার বড় গলাঃ নাজি জার্মান প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবলস বলেছিলেন, 'আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।' পাকিস্তান সরকার এই সাংবাদিকদের ভূগোল বুঝিয়েছিল যে, ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি সৈনিক ও প্যারামিলিটারিরা অবাঙালিদের উপর নির্মমভাবে আক্রমণ করে। হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে (বিহারি) নির্দয়ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ২০হাজারের বেশী অবাঙালির লাশ পাওয়া গেছে আর হতাহতের আনুমানিক সংখ্যা এক লাখের মত। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পরিকল্পিতভাবে এই অবাস্তব ঘটনা গুলো নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে। 🟥আঘাতের পূর্বেই প্রতিঘাত(Pre-emtive Strike): হিন্দু শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ হল থেকে মর্টার হামলা করেছে অজুহাত তোলে পাকিস্তান সরকার। অথচ ২৫শে মার্চ যখন পাক আর্মি ইউনিটগুলো ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন অনেক ইউনিটের কাছে কাদের হত্যা করতে হবে তার তালিকা ছিল। এই প্রিলিস্টেড কিল চার্টে বিপুল সংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও আওয়ামী লীগের কর্মীর নাম ছিল। ২৬ ও ২৭ মার্চ ২৪ ঘন্টাব্যাপী পূর্নাঙ্গ কারফিউ চলা কালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বড় অংশ রাতের আঁধারে কিভাবে উধাও হয়ে গেলো সেই অংক ও মেলে না। 🟥বাঘের হরিণ শিকার: জিওগ্রাফি চ্যানেলে আমরা প্রায়ই দেখি এসব ডকুমেন্টারি। কিন্তু GENOCIDE রিপোর্টের শুরুটা বাস্তবে হওয়া রক্ত হিম করা এমন ঘটনা ছিলো। সেদিন আব্দুল বারি নামের ঢাকা নিউমার্কেটের এক দর্জিকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছিল পাকিস্তানি ফৌজিরা। তার একটাই ভুল ছিলো, পাকিস্তানি সেনা পেট্রোলের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করা। মাসকারেনহাস 'লোকটাকে খুন করতে চাইছেন কেনো?' জিজ্ঞেস করায় নবম ডিভিশনের মেজর রাঠোর কৈফিয়ত দিয়েছিল_'লোকটা হিন্দু হতে পারে,দেশদ্রোহী হতে পারে, সম্ভবত ছাত্র বা আওয়ামী লীগের কর্মী।' কুমিল্লা সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণে ট্রাক ভর্তি মানুষ নিয়ে আসা হতো বিচারের জন্য। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা মানুষের কান্নাও শোনা যেত। 🟥চারটা পঁচা মুন্ডুঃ ১৫ এপ্রিল মাসকারেনহাস সরজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন, ইকবাল হলের ছাদে চার জন ছাত্রের মাথা পড়ে আছে আর তাতে ইতোমধ্যে পচন ধরেছে। দেয়াল গুলো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। প্রচুর ডিডিটি পাউডার ছড়ানোর পরও সিঁড়িতে উৎকট গন্ধে টেকা দায়। প্রতিবেশীরা মাসকারেনহাসকে জানিয়েছিল, ২৩ জন হিন্দু নারী ও শিশুর লাশ ছাদে পঁচছিল, পরে আর্মিরা সরিয়ে নিয়ে গেছে। 🟥কিল এন্ড বার্ন মিশনঃ মাসকারেনহাস কুমিল্লা থেকে লাকসাম যাওয়ার পথে মাইলের পর মাইল ফাঁকা গ্রাম তার নজরে পড়ে। 'বাঙালিরা কই?' এর রেডি মেড উত্তর থাকত 'তারা গ্রামে গেছে।' গ্রামগুলোতে পাকিস্তানি জওয়ানরা নারিকেল পাতা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিত। কোনো কোনো গ্রামে পোড়া নারিকেল গাছের সাথে হাত-পা ছড়ানো লাশ ও পড়ে থাকতে দেখা যেত। এপ্রিলের এই ঘটনাগুলোর সময় কালবৈশাখী ঝড়ের কথা রিপোর্টে লেখা আছে। ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর ইফতিখার এটা নিয়ে আফসোস করে পরে বলেছিল 'মাত্র ৬০টা ঘর পুড়িয়েছি। বৃষ্টি না হলে সবগুলো জ্বালিয়ে দিতে পারতাম।' 🟥সুন্দরী মুক্তি স্নাইপারঃ একটা মাটির দেয়ালের আড়ালে একজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে দেখে পাক জওয়ানরা সর্তক হয়ে গাড়ি থামালো। মুক্তিবাহিনির স্নাইপার কিনা যাচাই করতে গিয়ে চেক করে দেখা গেলো একজন সুন্দর হিন্দু তরুনী নির্বিকারভাবে বসে আছে। তাকে গ্রামে যাবার জন্য নির্দেশ দিলে বিড়বিড় করে কিছু বললো। ২য়বার ধমকানো হলে সে উত্তরে বলেছিল 'আমার যাবার কোনো জায়গা নেই- না কোনো পরিবার, না কোনো ঘর।' মাসকারেনহাস চলে আসার সময়ও দেখেছিল, মেয়েটা ওভাবেই বসে আছে। 🟥শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া ও পুর্নবাসনঃ নবম ডিভিশনের মেজর বশির বলেছিল,' এই যুদ্ধ শুদ্ধ ও অশুদ্ধের। এখানকার লোকদের মুসলিম নাম থাকতে পারে এবং তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু অন্তর থেকে তারা হিন্দু।' এই ভয়াবহ সামরিক অভিযানের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত হিন্দু ও বিদ্রোহী বাঙালি মেরে পূর্ব পাকিস্তানকে একটা উপনিবেশে পরিণত করা এবং দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের অনুগত শান্তি কমিটির লোকজন দিয়ে শুদ্ধ বাঙালিদের পুর্নবাসন করা। এই প্রক্রিয়া চালুর রাখতে সামরিক রিজার্ভের ২৫ হাজার সৈন্যের নবম ও ষোড়শ আর্মি ডিভিশনকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের মাধ্যমে উড়িয়ে আনা হয়। ১৬ এপ্রিল নবম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা বলেন,'নিশ্চিত থাকুন যে আমরা এ রকম চরম ও ব্যয়বহুল অভিযান অযথা শুরু করিনি…..আমরা এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছিল এবং তা শেষ করব।' *(নির্বিচারে খুন করতে থাকব যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙালিরা কথা না শোনে) 🟥রক্তচোষা দুর্ভিক্ষঃ মুক্তিযোদ্ধারা ৬টা বড় ও অসংখ্য ছোট সেতুসহ রেললাইন ধ্বংস করে দিয়েছিল বাধ্য হয়ে। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও স্পষ্ট ছিল। অথচ পাকিস্তানি কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান মি. কার্নি দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলোচনার সময় বলেন,'এই দুর্ভিক্ষ তাদের অন্তর্ঘাতের ফল। তাই তারা মরুক। হয়তো তখন বাঙালিদের হুঁশ ফিরবে।' 🟥দুনিয়া কাঁপানো রিপোর্টের মূল সারমর্মঃ পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ৩টি মূল নীতি ছিল। ১.বাঙালিরা অবিশ্বস্ত, তাদের সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ২.তাদের ইসলামি ধারায় পুনরায় শিক্ষিত করতে হবে। ৩.হিন্দুদের মেরে তাদের সম্পদের লোভ দেখিয়ে মধ্যবিত্ত মুসলিমদের দলে টানতে হবে। .....এই নীতিমালার সরল রূপরেখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশে পরিণত করা। বাঙালিদের একটাই দোষ ছিল তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল আর নির্বাচনে জিতে সেটা তারা প্রমাণ ও করেছিল। '৪৭ এর দেশ ভাগের পর পাকিস্তানে সব সময় পাঞ্জাবিদের স্বার্থ মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং এখানেও ক্ষমতার পালাবদল তারা মেনে নিতে পারছিলো না। তাদের এই ভন্ডামিকে এক কথায় বললে,ধর্মের আড়ালে ক্ষমতার রাজনীতি। 🟥একজন আদর্শবান পাকিস্থানিঃ ছোট থেকেই মায়ের আদর্শে বড় হওয়া মাসকারেনহাস সব সময় নীতিবান ছিলেন। তিনি বলতেন_'আমার সামনে যদি একটি পাহাড়ও রাখো, সত্য প্রকাশের জন্য আমি সেটি টপকে যাবো।' মে মাসে ভূয়া রিপোর্ট জমা দেয়ার পর থেকেই তিনি বিবেকের দংশনে পুড়তে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে ঘটা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ তার মনকে ক্ষুব্ধ, চিন্তিত ও বিষণ্ন করে তুলেছিল। অন্তরে তীব্র অনুশোচনায় তার ওয়াইফকে বলেছিলেন_'আমি যা দেখেছি হয় তার সবটা আমি লিখব নয়তো আমাকে লেখা ছেড়ে দিতে হবে। আমি আর কখনো সততা নিয়ে লিখতে পারব না।' এরপর তার ��নে থাকা খন্ড খন্ড ঘটনাগুলা জোড়া দিয়ে লিখে ফেলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যার দলিল। 🟥প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়াঃ মাসকারেনহাসের লেখা '৭১ সালের ১৩ জুন ‘GENOCIDE’ শিরোনামে দ্য সানডে টাইমসে প্রকাশের পর গোটা বিশ্বের মানুষ শিউরে ওঠে। বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও বাইরের বিশ্বের কাছে পুরো বিষয়টাই ধোঁয়াশা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির গনহত্যার এই প্রত্যক্ষ বিবরণ পড়লে আপনারও চোখে পানি এসে যাবে। কি বীভৎসভাবে একজনকে তিনবার গুলি করে মারা হয়েছে, জ্যান্ত মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার বর্ণনা আর জায়গায় জায়গায় মরে পড়ে থাকা পঁচা গলা বাঙালিদের রক্ত, লাশের স্তুপের দলিলপত্র এটি। মাসকারেনহাস স্পষ্ট করে বার বার উল্লেখ করেছেন, 'পাক সামরিক নেতারা ঠান্ডা মাথায় এই গনহ*ত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং পুরোপুরি ঠান্ডা মাথায় সেই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে।' এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বড় পরিবর্তন আসে কারণ এটি ছিল একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের লেখা এবং এর ফলাফলে মুক্তিযুদ্ধে বর্হিবিশ্বের সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ চলে আসে। 🟥অনুবাদ ও প্রোডাকশন কোয়ালিটিঃ মোস্তাফিজ কারিগরের করা প্রচ্ছদগুলো সব সবই অসাধারণ লাগে আমার কাছে। ক্রাউন সাইজের পেপারব্যাক বইটির প্রোডাকশন ও দুর্দান্ত হয়েছে। অনুবাদের কয়েক লাইন আমার কাছে সাবলীল মনে হয়নি। তবে প্রকাশনী ২০২৩ সালের ২৬ মার্চের আগেই নতুন সংষ্করণে এটা ঠিক করে নিবে জানিয়েছে। 🟠bari had ran out of luck বারি দৌড়েছিল ভাগ্যকে সম্বল করে। 🟠You are new here and I see you have a squeamish stomach. আপনি এখানে নতুন এবং আমার মনে হয় আপনি কিছুটা খুঁতখুঁতে। 🟠Tropical Storm ক্রান্তীয় ঝড় 🟥 যশোর চাঁচড়া বধ্যভূমি আমার বাসার খুব কাছেই। সারা বছরই জায়গাটা অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে। হয়ত এই প্রজন্মের কারোর এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার ইচ্ছে নাই। অনুরোধ থাকলো এই বইটা অন্তত পড়ার। শুধু পড়ার জন্যই না, এটা সবার বাসায় একটা করে থাকা উচিত। বইটা পড়ার পর আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন বার বার এসেছে, আমাদের স্কুল কলেজের পাঠ্যবইয়ের সাথে এটা পড়ানো হয় না কেনো?
বইটি পড়ে অনেক নতুন কিছু জানতে পারলাম। বিশেষত বিহারী জনগোষ্ঠী ও বাঙালিদের তাদের ওপর আক্রমণকে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কারণ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা।
This entire review has been hidden because of spoilers.