বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১ নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম (বীরত্বের জন্য বাংলাদেশের জীবিত ব্যাক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ খেতাব) খেতাব প্রদান করে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নাওড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আশরাফ উল্লাহ এবং মায়ের নাম রহিমা বেগম। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। লেখাপড়া করেন নাওড়া প্রাথমিক স্কুল, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরের পালং, কুমিল্লার চান্দিনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৫৯ সালে অন্নদা মডেল হাই স্কুল থেকে মেট্রিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভাড বিজনেস স্কুলে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালীন সময়েই রফিকুল ইসলাম সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। সাংবাদিকতার আগ্রহ থাকায় ছাত্রাবস্থাতেই কাজ শুরু করেন 'ইউপিপি' সংবাদ সংস্থায়। ১৯৬৩তে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারী একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ লাভের পর ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন পান। পরে তাঁকে আর্টিলারী কোরে নেয়া হয়। ১৯৬৮তে লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাকে বদলি করে দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তিনি নিজ রেজিমেন্টসহ যশোর ক্যান্টনমেন্টে রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিছুদিন পর তাঁকে ডেপুটেশনে বদলি করা হয় দিনাজপুরে ইপিআর এর ৮ নং উইংয়ের অ্যাসিসটেন্ট উইং কমান্ডার পদে। সেখান থেকে ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্-এর চট্টগ্রাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে পোষ্টিং দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান ১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন পরিস্থিতি দেখে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি স্বাধীনতার প্রয়োজনে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তদনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।তাঁর অধীনস্থ বাঙালি অফিসার ও সিপাহিদের সাথে আলোচনা করে কর্তব্য স্থির করেন এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের সাথে গোপন বৈঠকে বিদ্রোহের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতেই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম কার্যত বিদ্রোহ শুরু করেন। তাঁর আদেশে সীমান্ত ফাঁড়িতে বাঙালি সৈন্যরা অবাঙালি সিপাহিদের নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রিয় করে চট্টগ্রামে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে প্রস্তুত হয়। এম. আর. চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমানের অনুরোধে সেদিন রফিকুল ইসলাম তাদের চট্টগ্রামে আসার নির্দেশ বাতিল করেন। কিন্তু পরদিন ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য অনুধাবন করে ক্যাপ্টেন রফিক সক্রিয় বিদ্রোহ শুরু করেন এবং ইপিআরের অবাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের জীবিত বন্দী করে রেলওয়ে হিলে তাঁর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। তাঁর অধীনে ন্যস্ত সৈনিকরা এম. ভি. সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সময়োচিত সিদ্ধান্তের অভাবে ২০ বালুচ রেজিমেন্ট-এর সৈন্যরা চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার-এর সহস্রাধিক বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে সপরিবারে হত্যা করে। মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে অবস্থান নেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চট্টগ্রামের অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনস্থ ইপিআর সৈনিকদের মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনীর সাথে যোগদানে বাধা দেন এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। এ কারণে ক্যাপ্টেন রফিক সেনাবলের অভাবে চট্টগ্রামে যথাযথ দখল বজায় রাখতে ব্যর্থ হন এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধন করে পশ্চাদপসরণ করেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন রফিক তাঁর বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেন এবং ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তাঁর হেডকোয়ার্টার সীমান্তের ওপারে হরিণায় স্থাপন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে এখান থেকেই তিনি ১ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।